Monday, April 7, 2025

Soul: আত্মার অবিনশ্বরতা ও সংখ্যার অপরিবর্তনীয়তা।

 আত্মাসমূহকে একই সাথে সৃষ্টি করা হয়েছে (৭:১৭২) এই তথ্য থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, কোন মানব সন্তানের দুনিয়াতে অস্তিত্ব লাভের পূর্বেই তার আত্মা (Soul) এক সূদীর্ঘ সময় অদৃশ্যলোকে কাটিয়ে আসছে। তেমনি দেহের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আবার সে দৃশ্যলোক থেকে অদৃশ্যলোকে পাড়ি জমায়। অর্থাৎ নশ্বর ও অবিনশ্বর জগতের সাথে একমাত্র আত্মার সংযোগ রয়েছে। 


মানুষের জীবন ষাট-সত্তুর বৎসরের যে পরিধি, মহাকালের তুলনায় তা ক্ষণকাল, বরং তা ক্ষণকালের চেয়েও অল্প। আর এই ক্ষণকালের মধ্যে কারও পক্ষে বৃহৎ কিম্বা শ্রেষ্ঠ হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং যে অমর তার পক্ষে সমগ্র কালকে উপেক্ষা করে কি এই ক্ষণকালের উপর গুরুত্ব আরোপ করা সম্ভব? নিশ্চয় নয়। সুতরাং মানুষের আত্মা যদি অমর ও অক্ষয় হয় তবে তা অবশ্যই সমগ্র কালকেই গুরুত্ব দেবে; দেহের মৃত্যুর পর সে পাড়ি জমাবে অনন্ত জীবনের পথে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রত্যেক সত্ত্বার মধ্যে উত্তম এবং অধমের অস্তিত্ব আছে। অধম সেটাই যা কিছু অপর কিছুকে দূষিত করে কিম্বা ধ্বংস করে, আর উত্তম তাকেই বলা যাবে যা অপর কিছুকে রক্ষা করে এবং তাকে উন্নত করে। চোখের কথা যদি ধরি, চোখের প্রদাহ হচ্ছে তার অধম অবস্থা। সমগ্র দেহের কথা ধরলে, রোগ হচ্ছে দেহের অধম অবস্থা। তেমনি শস্যের অধম অবস্থা হচ্ছে উদ্ভিদ রোগ, কাঠের ক্ষেত্রে তার পচন, তাম্র এবং লৌহের ক্ষেত্রে তার মরচে পড়া ইত্যাদি। মোট কথা, প্রায় প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই তার ক্ষয় কিম্বা অধমের একটা দিক আছে এবং কোন কিছু যদি এই ক্ষয় দ্বারা আক্রান্ত বা সংক্রমিত হয়, তাহলে পরিণামে তার ধ্বংস অনিবার্য। অর্থাৎ পরিণামে সে মৃত্যূমুখে পতিত হয় বা সে সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্বহীন হয়ে যায়। আর যে বস্তুকে কোন ক্ষয় আক্রমণ করে ক্ষতিগ্রস্থ করলেও যাকে ধ্বংস করতে পারে না, তাই অক্ষয়।

এ কথা সত্য যে, দৃশ্যলোক তথা দুনিয়ার সকল জীবন্ত প্রাণীর সৃষ্টি, পুষ্টি, বৃদ্ধি ও ক্ষয় সূর্যের দ্বারা সাধিত হয়। এই দৃশ্যলোকে এমন কি কিছু আছে যা আত্মার ক্ষতিসাধন করতে পারে। অন্যায়, অরাজকতা, কাপুরুষতা এবং অজ্ঞতা প্রভৃতি আত্মার ক্ষতিসাধন করে বটে তথাপি এগুলোর কোনকিছু আত্মাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে পারে কি? 

আত্মা দুষ্ট হয়ে যেতে পারে; দুষ্ট আত্মা অন্যায় কর্ম সাধনকালে ধরা পড়তে পারে; কিন্তু এই দুষ্ট শক্তির কারণে সে সম্পূর্ণরূপে ধবংস হয়ে যায়, এরূপ ভাবা ঠিক হবে না। বরং বিষয়টি অন্যদিক থেকে দেখা যাক। দেহের দুষ্ট শক্তি হচ্ছে তার রোগ। রোগ তাকে ক্ষয়গ্রস্থ করে; তার ধ্বংস সাধন করে। পরিণামে দেহের অস্তিত্ব বিনষ্ট হয়ে যায়। এভাবে আত্মাকেও বিচার করা যাক। আত্মার মধ্যে অন্যায় এবং অপর দুষ্ট শক্তির অস্তিত্ব কি আত্মাকে এরূপভাবে দুর্বল এবং বিনষ্ট করতে পারে, যাতে আত্মা আর আত্মা হিসেবে অস্তিত্বশীল থাকতে পারে না, আত্মার মৃত্যু ঘটে যায় এবং সে দেহ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়? না এরূপ ধ্বংস সাধন সম্ভব নয়। আবার এমনটা ভাবাও যৌক্তিক নয় যে, নিজের ক্ষয়ে কেউ বিনষ্ট হয় না, বিনষ্ট হয় সে অপরের ক্ষয়ে।

যদি দেহের মৃত্যু ঘটে পুরোনো এবং দূষিত খাদ্যের কারণে কিম্বা খাদ্যের অপর কোন ত্রুটির কারণে অথবা যদি খাদ্যের এমন কোন ত্র“টির কারণে দেহের মধ্যে ক্ষয়ের যাত্রা শুরু হয়, তাহলে এটাই বলা সঙ্গত যে, দেহের মৃত্যু ঘটেছে তার নিজস্ব স্বভাবের কারণে; নিকৃষ্ট খাদ্য তার একটি উপলক্ষ মাত্র। কারণ দেহ এবং নিকৃষ্ট খাদ্য স্বভাবগত ভাবে পৃথক। এদের যোগ এখানে মাত্র এতটুকুই যে, নিকৃষ্ট খাদ্য দেহের নিকৃষ্ট স্বভাবকে ক্রিয়াশীল করে তুলতে পারে। এই যুক্তিতে বলা চলে যে, দেহের রোগ যদি আত্মার স্বভাবের নিজস্ব রোগকে ক্রিয়াশীল করে তুলতে না পারে তাহলে এটা বলা সঙ্গত নয় যে, দেহের রোগে আত্মার মৃত্যু ঘটতে পারে। এরূপ বলার অর্থ হবে, স্বভাবগত ভাবে যারা একেবারে পৃথক তাদের একের রোগ অপরকে ধ্বংস করতে সক্ষম।

এই যুক্তি না খন্ডানো পর্যন্ত এই অভিমতই পোষণ করা যায় যে, দেহের জ্বরা কিম্বা তার অপর কোন রোগ কিম্বা অপর কোন আঘাত-এমনকি দেহ যদি ছিন্নভিন্ন হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্তও হয়, তবুও দেহের এরূপ কোন অবস্থা আত্মাকে প্রভাবিত বা ধ্বংস করতে পারে না। আত্মা আপন স্বভাবে যা ছিল, দেহের এরূপ কোন বিকার বা অবস্থা তাকে অধিকতর অন্যায়ে বা অধমে পর্যবসিত করতে পারে- এটা কেউ প্রমাণ না করা পর্যন্ত এই অভিমতের কোন পরিবর্তন ঘটতে পারে না। এ কথা বলা যাবে না আত্মা বা অপর কোন কিছুই নিজস্ব স্বভাবের কোন বিকার ব্যতিত, ভিন্নতর অস্তিত্বের স্বভাবগত বিকারে ধ্বংস হতে পারে। মোটকথা কারও পক্ষেই এরূপ প্রমাণ করা সম্ভব নয় যে, মৃত্যু আত্মাকে নৈতিকভাবে কোন অধম সত্ত্বায় পর্যবসিত করে। কিন্তু কেউ যদি এই যুক্তি না মেনে আত্মার অমরতাকে অস্বীকার করার জন্যে বলে, মানুষ মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে অধমতর অস্তিত্বে পর্যবসিত হয়, তবুও বলব, তার অভিমত সত্য হলেও মানুষের নিজের স্বভাবের দুষ্ট শক্তির কারণেই অধমতর অস্তিত্বে পরিণত হয়। আইনের দেয়া মৃত্যুদন্ডের জন্যে অপরাধীর মৃত্যু নয়; তার মৃত্যু ঘটেছে তার স্বভাবের মধ্যেকার মারাত্মক রোগের কারণে।

ভিতর থেকে মানুষের নিজের দুষ্ট শক্তি যদি তাকে মারাত্মকভাবে ক্ষয়গ্রস্থ করে থাকে, তাহলে যে কোন আঘাতেই তার মৃত্যু ঘটতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটা হচ্ছে একেবারে বিপরীত। দুষ্ট শক্তি নিজের মৃত্যু ঘটায় না, মৃত্যু ঘটায় অপরের। অপরদিকে, যার স্বভাবের মধ্যে এই দুষ্ট শক্তির অবস্থান, সে মৃত্যুর বদলে অধিকতর উদ্দীপনার সঙ্গে জীবনকে উপভোগ করতে থাকে।

আত্মার নিজের স্বভাবের বিকার যদি আত্মাকে ধ্বংস করতে না পারে তাহলে সাধারণ নিয়মের ক্ষেত্রেও এর কোন ব্যতিক্রম হবে না। সুতরাং সাধারণ নিয়মেই বলা চলে, কোন কিছুই এমন কোন শক্তির দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে পারে না, যে শক্তির ধ্বংসের লক্ষ্য ভিন্নতর কোন অস্তিত্ব, তার নিজের অস্তিত্ব নয়। বস্তুত: নিজের ধ্বংস কেবল নিজেই সাধন করতে পারে, অপরে নয়।

সুতরাং আত্মার ক্ষেত্রে সত্যটি যদি এই হয় যে, তার নিজের স্বভাব কিম্বা অপরের বিকার, কোন কিছুই তাকে ধ্বংস করতে পারে না, তাহলে আত্মা অবিনশ্বর, আত্মার অস্তিত্ব চিরন্তন। অন্য কথায় বলা যায়- আত্মা অমর। আর একথা যদি সত্য হয়, তাহলে একথাও সত্য যে, একই আত্মা চিরকাল অস্তিত্বশীল। কারণ, আত্মার সংখ্যার কোন হ্রাস ঘটতে পারে না। কোন আত্মারই মৃত্যু ঘটে না। আবার আত্মার সংখ্যার বৃদ্ধিও ঘটতে পারে না। কারণ অমরতার বৃদ্ধি মরণশীলের বিনিময়েই যদি ঘটতে পারত, তাহলে সবকিছুই পরিণামে অমর হয়ে যেত। কিন্তু যুক্তির ভিত্তিতে তেমন কথা কেউ বলতে পারে না এবং একথাও কেউ বলতে পারে না যে, আত্মা তার স্বভাবের মৌলিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে পরিবর্তনীয় কিম্বা অস্থির কিম্বা অন্তর্দ্বন্দ্বপূর্ণ হতে পারে। কারণ, পরস্পর বিরোধী বহু উপাদানে যে গঠিত, তার পক্ষে অবিনশ্বর হওয়া কঠিন। সুতরাং আত্মা অমর- প্রদত্ত সমস্ত যুক্তিই তা প্রমাণ করে।

আত্মা অমর এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার সাথে সাথে আমরা বুঝতে পারলাম আত্মা সকল মঙ্গল এবং অমঙ্গলকে অতিক্রম করতে সক্ষম। আত্মাই আমাদের পথ প্রদর্শক। আত্মাই আমাদের দৃঢ় পদক্ষেপে নিয়ত অগ্রসর করে নিয়ে যায় সম্মুখ পানে এবং উর্দ্ধপানে। ন্যায় এবং জ্ঞানের সাধনায় আত্মাই আমাদের উদ্দীপিত করে। আর আত্মার অমরতায় বিশ্বাস ইহলোকে এবং পরলোকে আমাদের মনে শান্তি স্থাপন করবে। দুনিয়াতে আমাদেরকে ন্যায়বান হতে সহায়তা করবে, বিধাতার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক দৃঢ় করবে। আর ক্রীড়া শেষে বিজয়ীর ন্যায় সম্মানের শিরোপা সংগ্রহ যখন আমাদের এ জীবনে সমাপ্ত হবে এবং পরলোকের সহস্র বর্ষের দীর্ঘ বিচার কার্য যখন আমাদের শুরু হবে, তখন উদ্বেগহীন চিত্তে সেই বিচারে আমরা সৃষ্টিকর্তার মুখোমুখী হতে নিশ্চয়ই সক্ষম হব।

সমাপ্ত।

SourceThe Republic by Plato. 

No comments:

Post a Comment